Monday, September 18, 2017

ফরজ নামাজের পরে হাত তুলে মুনাজাত করা প্রসঙ্গে।

ফরজ নামাযের পর মুনাজাতের বিষয় বুঝতে হলে আমাদেরকে দুটি পয়েন্ট ভাল করে বুঝতে হবে। যথা-

১.ফরজ নামাযের পর একাকি হাত তুলে  মুনাজাত জায়েয কি না?

২ .ফরজ নামাযের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে মুনাজাত জায়েয কি না?

এখন ১নং মাসআলা তথা ফরজ নামাযের পর একাকি হাত তুলে  মুনাজাত ইসলামী শরীয়তে সম্পুর্ণরুপেই  জায়েয যা নবীজির একাধিক হাদিস দ্বারা প্রমানিত।নিম্ণে এ সম্পর্কে কিছু হাদিস পেশ করা হল-
★তিরমিজি শরিপ ৩৭৫ নং হাদিস এসেছে-عن الفضل بن عباس (رض) قال قال رسول الله (صلي) الصلاۃ مثني مثني تشهد في كل ركعتين وتخشع و تمسكن ثم تقنع يديك يقول ترفعهما الي ربك مستقبلا ببطونهما وجهك و تقول يا رب يا رب و من لم يفعل ذلك فهو كذا و في روايۃ فهو خداج
অর্থ-হযরত ফজল ইবনে আব্বাস (রাঃ)থেকে বর্ণিত,রাসুল (সাঃ)ইরশাদ করেন,নামাজের নিম্ন পরিমান দুরাকাত দুরাকাত (যেমন ফজরের নামাজ)। প্রতি দুরাকাতে তাশাহুদ পাঠ করা, খুশু খুজু,বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করতে হয়।অতঃপর তোমার প্রভুর দরবারে হাত দুখানা মুখমণ্ডল বরাবর উঠায়ে, ইয়া রব!ইয়া রব!বলে দোয়া করবে ।যে ব্যক্তি এরুপ নামাজ বাদ হাত উত্তোলোন করে দোয়া করেন না তার নামাজ অসম্পূর্ণ। এ হাদিস থেকে বুঝা যায় যে,নামাজ পড়ে হাত তোলা দোয়া করা রাসুলের নির্দেশ। ★মাজমাউয যাওয়ায়েদ ওয়া মানবাউল ফাওয়ায়েদ নামক কিতাবের ১৭৩৪৫ নং হাদিসে এসেছে-
عن بن الزبير انه راي رجلا رافعا يديه يدعوا قبل ان يفرغ من صلاته فلما فرغ منها قال ان رسول الله (صلي)لم يكن يرفع يديه حتي يفرغ من صلاتهঅর্থাৎ-হযরত ইবনে যুবাইর (রাঃ)থেকে বর্ণিত,তিনি এক ব্যক্তিকে তার নামাজ শেষ করার আগেই হাত তুলে দোয়া করতে দেখলেন।অতঃপর এ লোকটি যখন নামাজ শেষ করলেন তিনি তাকে বললেন,নিশ্চয় রাসুল (সাঃ) নামাজ শেষ হওয়ার আগে হাত তুলে দোয়া করতেন না। অর্থাৎ তিনি নামাজ শেষ করেই হাত তুলে দোয়া করতেন। এ হাদিস দ্বারাও বুঝা যাচ্ছে যে,রাসুলের অভ্যাস ছিল নামােজর শেষে হাত তুলে দোয়া করা ।
★তাফসিরে ইবনে কাসির সুরা নিসার ১০০ নং আয়াতের তাফসিরে একখানা হাদিস এসেছে -عن ابي هريرۃ (رض)ان رسول الله (صلي)رفع يده بعد ما سلم و هو مستقبل القبلۃ فقال اللهم خلص الوليد بن الوليد و عياش بن ابي ربيعۃ و سلمۃ بن هشام و ضعفۃ المسلمين الذين لا يستطيعون حيلۃ ولا يهتدون سبيلا من ايدي الكفار
 অর্থ-হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ)থেকে বর্ণিত,নিশ্চয় রাসুল (সাঃ)নামাজের সালাম ফিরনোর পর কিবলার দিকে ফিরিয়ে দুহাত তুলে দোয়া করতেন,হে আল্লাহ আপনি ইবনে অলিদ,ইবনে আবি রবিয়া,ইবনে হিশাম ও এমন সব দূবল মুসলিমদের কাফিরদের হাত থেকে রক্ষা করুন যাদের কাছে নেই কোন কৌশল এবং নেই কোন বিকল্প রাস্তা। এ হাদিস দ্বারাও বুঝা যাচ্ছে রাসুল (সাঃ) নামাজ পড়ে দুহাত তুলে দোয়া করতেন।
★আল্লামা ইবনুস সানি লিখিত ,আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ নামক কিতাবের ১২১পৃষ্ঠায় একখানা হাদিস এসেছে-
عن انس (رض) عن النبي (صلي)انه قال ما من عبد بسط كفيه في دبر كل صلاۃ ثم يقول اللهم الهي و اله ابراهيم و اسحاق و يعقوب و اله جبراءيل و ميكاءيل و اسرافيل اسءلك ان تستجيب دعوتي فاني مضطر و تعصمني في ديني فاني مبتلي و تنا لني برحمتك فاني مذنب و تنفي عن الفقر فاني متمسكن الا كان علي الله ان لا يرد يديه خاءبينঅর্থাৎ-হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত রাসুল (সাঃ)থেকে বর্ণনা করেন,রাসুল (সাঃ)বলেন,যখন কোন বান্দা প্রত্যেক নামাজের পর দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে এ দোয়া করে যে,اللهم الهي و اله ابراهيم............................و تنفي عنرالفقر فاني متمسكن)তখন আল্লাহর উপরে কর্তব্য হয়ে যায় যে তার দুহাতকে নিরাশ অবস্হায় ফিরিয়ে না দেয়া। উপরের হাদিসখানাতেও নামাজের পর হাত তুলে দোয়া করার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।

★ইমাম বুখারি (রঃ) এর লিখিত, আত-তারিখুল কাবির কিতাবের ৬/৮০ পৃষ্ঠায় হাদিস এসেছে-
عن المغيرۃ (رض)كان النبي (صلي) يدعوا في دبر صلاته
অর্থাৎ রাসুল (সাঃ) সবসময় তার নামাজ শেষ করে দোয়া করতেন। এ হাদিসখানাতে বুঝানো হয়েছে যে,রাসুল (সাঃ) সবসময় নামাজের শেষে দোয়া করতেন।আবার অন্য আরেকখানা হাদিসে রাসুল (সাঃ) এর দোয়ার পদ্ধতি বলা হয়েছে যে,রাসুল (সাঃ) যখনই কোন দোয়া করতেন তখনই হাত উঠাতেন।
যেমন: আবু দাউদ শরিপ ১৪৯২ নং হাদিসে এসেছে
عن الساءب بن يزيد (رض)عن ابيه ان النبي (صلي)كان اذا دعا رفع يديه مسح وجهه بيديه
অর্থাৎ রাসুল (সাঃ) যখনই দোয়া করতেন তখনই হাত উঠিয়ে দোয়া করতেন এবং দুহাত দ্বারা তার মুখমণ্ডলকে মাসেহ করতেন।

উপরের দুই হাদিসের প্রথম হাদিস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে রাসুল (সাঃ)প্রত্যেক নামাজের শেষে দোয়া করতেন আর দ্বিতীয় হাদিস দ্বারা বুঝা যায় রাসুল অধিকাংশ দোয়াতেই হাত উঠাতেন।সুতরাং দুহাদিসকে মিলিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে রাসুল (সাঃ)প্রত্যেক নামাজের পরেই হাত তুলে দোয়া করতেন।

★পূর্বের আলোচনা দ্বারা পরিস্কার হয়ে গেল যে, রাসূল সাঃ ফরজ নামায শেষে হাত তুলে দুআ করতেন। এখন প্রশ্ন হল, রাসূল সাঃ ও সাহাবায়ে কেরাম রাঃ থেকে সম্মিলিতভাবে দুআ করা প্রমাণিত কি না?
নিচে কয়েকটি হাদীস দেয়া হল। যা পরিস্কারভাবে সম্মিলিত দুআ করা ও সম্মিলিত দুআর প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

১.আলবিদায়া ওয়াননিহায়া গ্রন্থে আল্লামা ইবনে কাসীর রহঃ সনদসহ একখানা হাদিস বর্ণনা করেছেন।যার সারমর্ম হল,
আলা বিন হাযরামী রাঃ। মুস্তাজাবুদ দাওয়া সাহাবী ছিলেন। একদা বাহরাইনের জিহাদ থেকে ফেরার পথে এক স্থানে যাত্রাবিরতি করলে খাবার দাবার ও তাবুর রসদসহ উটগুলো পালিয়ে যায়। তখন গভীর রাত। সবাই পেরেশান। ফজরের সময় হয়ে গেলে আজান হল। সবাই নামায আদায় করলেন। নামায শেষে আলা বিন হাযরামী রাঃ সহ সবাই হাত তুলে সূর্য উদিত হওয়ার সূর্যের কিরণ গায়ে লাগা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় দুআ করতে থাকেন। {আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৬/৩২৮-৩২৯}
এ হাদিস দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় সাহাবিরা ফজরের নামাজ পড়ে সম্মিলিতভাবে দোয়া করেছেন।আর সাহাবিদের কাজ কখনও বেদআত হতে পারে না

২.আলমুজামুল কাবীর নামক হাদিসের কিতাবে এসেছে-
عَنْ حَبِيبِ بْنِ مَسْلَمَةَ الْفِهْرِيِّ – وَكَانَ مُسْتَجَابًا -: أَنَّ
ُ أُمِّرَ عَلَى جَيْشٍ فَدَرِبَ الدُّرُوبِ، فَلَمَّا لَقِيَ الْعَدُوَّ قَالَ لِلنَّاسِ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – يَقُولُ: ” «لَا يَجْتَمِعُ مَلَأٌ فَيَدْعُو بَعْضُهُمْ وَيُؤَمِّنُ سَائِرُهُمْ، إِلَّا أَجَابَهُمُ اللَّهُ» “.
ثُمَّ إِنَّهُ حَمِدَ اللَّهَ، وَأَثْنَى عَلَيْهِ، وَقَالَ: اللَّهُمَّ احْقِنْ دِمَاءَنَا، وَاجْعَلْ أُجُورَنَا أُجُورَ الشُّهَدَاءِ
অর্থাৎ-হযরত হাবীব বিন মাসলামা আলফিহরী রাঃ। যিনি মুস্তাজাবুদ দাওয়া ছিলেন। তাকে একবার একটি বাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা হয়। যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের পর তিনি যখন শত্রুর সম্মুখিন হলেন। তখন লোকদের বললেন, আমি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন “যখনি কোন দল একত্র হয়, তারপর তাদের কথক দুআ করে, আর অপরদল আমীন বলে তখন আল্লাহ তাআলা তা কবুল করে নেন”।
এ হাদীস বলার তিনি [হাবীব বিন মাসলামা রাঃ] হামদ ও সানা পড়লেন। তারপর বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের প্রাণ রক্ষা কর। আর আমাদের শহীদের সওয়াব দান কর।(হাদীস নং-৩৫৩৬)
এ হাদিসেও সম্মিলিত মুনাজাতের প্রতি রাসুল (সাঃ)আমাদের উৎসাহিত করেছেন।

৩. সহীহ বুখারীতে এসেছে,হযরত আনাস (রাঃ)বর্ণিত,
قَالَ: أَتَى رَجُلٌ أَعْرَابِيٌّ مِنْ أَهْلِ البَدْوِ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ الجُمُعَةِ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، هَلَكَتِ المَاشِيَةُ، هَلَكَ العِيَالُ هَلَكَ النَّاسُ، «فَرَفَعَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَيْهِ، يَدْعُو، وَرَفَعَ النَّاسُ أَيْدِيَهُمْ مَعَهُ يَدْع
অর্থাৎ- একদা একজন গ্রাম্য সাহাবী রাসূল সাঃ এর কাছে আসলেন জুমআর দিন। এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! জিনিস পত্র, পরিবার, মানুষ সবই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একথা শুনে রাসূল সাঃ তার উভয় হাত উত্তলোন করলেন দুআর উদ্দেশ্যে। উপস্থিত সবাই রাসূল সাঃ এর সাথে দুআর জন্য হাত উত্তোলন করলেন। (হাদীস নং-১০২৯)

এ হাদীসে পরিস্কারভাবে রাসূল সাঃ থেকে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত প্রমানিত। লক্ষ্য করুন, রাসূল সাঃ দুআ করেছেন, আর উপস্থিত সাহাবীগণ আমীন আমীন বলে সম্মিলিত মুনাজাতে অংশ নিয়েছেন।

৪. হযরত সালমান রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন,
: «مَا رَفَعَ قَوْمٌ أَكُفَّهُمْ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ يَسْأَلُونَهُ شَيْئًا، إِلَّا كَانَ حَقًّا عَلَى اللهِ أَنْ يَضَعَ فِي أَيْدِيهِمُ الَّذِي سَأَلُوا
অর্থাৎ-  যখন কোন জামাআত তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করার আশায় আল্লাহর দরবারে হাত উঠায়, তখন আল্লাহর উপর হক হল প্রার্থিত বিষয় উক্ত জামাতকে প্রদান করা।
 {আলমুজামুল কাবীর লিততাবরানী, হাদীস নং-৬১৪২, আততারগীব ওয়াত তারহীব, হাদীস নং-১৪৪, মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১৭৩৪১, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং-৩১৪৫}
আল্লামা হায়ছামী রহঃ বলেন, এ হাদীসের সনদের সকল রাবীগণ সহীহের রাবী।{ মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১৭৩৪১}

এরকম আরো অসংখ্য বর্ণনা প্রমাণ করে সম্মলিত মুনাজাত এটি দুআ কবুলের আলামত। সেই সাথে উত্তম আমল। যা কিছুতেই বিদআত হতে পারে না। যে সম্মলিত মুনাজাত রাসূল সাঃ নিজে করেছেন সাহাবীদের নিয়ে, সাহাবায়ে কেরাম সাথিবর্গকে নিয়ে যে সম্মলিত মুনাজাত করেছেন, তা কী করে বিদআত হতে পারে?

সুতরাং বুঝা গেল যে, সম্মিলিত মুনাজাত করাও রাসূল সাঃ এবং সাহাবায়ে কেরাম রাঃ থেকে প্রমাণিত। সেই সাথে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করতে রাসূল সাঃ পরিস্কার ভাষায় উৎসাহ প্রদান করেছেন।

এখন যদি কোন ভাই বলে যে,শেষের তিনটি  হাদিসেতো নামাজের পরের কথা উল্লেখ নেই।তাদেরকে বলব,এ হাদিসগুলোর হুকুম হল-আম বা ব্যাপক যা সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। আর এ ব্যাপক হুকুম থেকে যদি আপনি নামাজের পরের হুকুমকে বাদ দিতে চান তাহলে আপনাকে আলাদএমন কোন দলিল দেখাতে হবে যেখানে বলা হয়েছে সম্মিলিত মুনাজাত জায়েয তবে নামাজের পরে জায়েয নেই।আর এ রকম কোন নিষেধাজ্ঞার হাদিস কেহ দেখাতে পারবেন না।
তবে এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। যথা-
১.ফরজ নামাযের পর দুআকে জরুরী মনে করা।

২.দুআকে নামাযের অংশ মনে করা।

৩.এ ছাড়া নামায পূর্ণ হয় না আকিদা রাখা।

 এ তিনটির কোন একটি পাওয়া গেলে উক্ত দুআ বিদআত হবে। কারণ এর কোন প্রমাণ নেই।

কিন্তু যদি উপরোক্ত কোন কারণ পাওয়া না যায়। বরং যেহেতু রাসূল সাঃ ফরজ নামাযের পর দুআ করেছেন, সেই সাথে সম্মিলিতভাবে দুআ করতে উৎসাহ প্রদান করেছেন, সেই সওয়াব পাবার আশায় যদি ইমাম সাহেব সম্মিলিতভাবে দুআ করেন, তাহলে উক্ত সম্মিলিত দুআকে বিদআত বলার কোন সুযোগ নেই। যদি কেউ বলে তাহলে সে হাদীসে নববী সম্পর্কে অজ্ঞ ছাড়া আর কিছু নয়।
والله اعلم بالصواب