Wednesday, November 2, 2016

ইমামের পিছনে মুক্তাদির সুরা ফাতিহা পাঠ করা প্রসঙ্গে।

বর্তমানে একদল লোককে বলতে শুনা যায় যে, নামাজের ভিতরে মুক্তাদি সুরা ফাতিহা পাঠ না করলে তার নামাজই হবে না। আসুন আমরা দেখি, তাদের এ কথাটি কতটুকু কোরআন ও হাদিস সম্মত?নামাজের ভিতরে মুক্তাতির সুরা ফাতিহা পাঠ করার হুকুম সম্পর্কে জানার পূর্বে আমাদেরকে সর্বপ্রথম কয়েকটি বিষয় বুঝতে হবে।যথা-
 1-একাকি নামাজে সুরা ফাতিহা পাঠ করার হুকুম।
2-জামাতে নামাজ পড়ার সময় ইমামের সুরা ফাতিহা পাঠের হুকুম।
3-জামাতে নামাজ পড়ার সময় মুক্তাতির সুরা ফাতিহা পাঠের হুকুম।3 নং মাসআলাটি আবার দুভাবে বিভক্ত।যথা-
ক-জাহরি নামাজে(যে নামাজে ইমাম কেরাত জোরে পড়ে)মুক্তাদির সুরা ফাতিহা পাঠের হুকুম ।
খ-সিররি নামাজে(যে নামাজে ইমাম কেরাত আস্তে পড়ে)মুক্তাদির সুরা ফাতিহা পাঠের হুকুম।

★1ও 2 নং মাসআলায় সকল আলেম একমত যে,এ অবস্হায় সুরা ফাতিহা অবশ্যই পাঠ করতে হবে ।সুরা ফাতিহা ব্যতিত তাদের নামাজই হবে না।দলিল-বুখারি শরীপের নিন্মোক্ত হাদিস -
 ﻋﻦ ﻋﺒﺎﺩﺓ ﺑﻦ ﺍﻟﺼﺎﻣﺖ ﺃﻥ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻗﺎﻝ ﻻ ﺻﻼﺓ ﻟﻤﻦ ﻟﻢ ﻳﻘﺮﺃ ﺑﻔﺎﺗﺤﺔ ﺍﻟﻜﺘﺎﺏ
অর্থ- হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রা:)থেকে বর্নিত,তিনি বলেন,রাসুল (সাঃ) বলেন,যে ব্যক্তি সুরা ফাতিহা পড়বেনা তার নামাজই হবে না।(বুখারি শরীপ723নং)

 **3নং মাসআলার ক অর্থাৎ (যে নামাজে ইমাম কেরাত জোরে পড়ে যেমন ফজর,মাগরিব,ও এশার নামাজ) এ মাসআলায়ও সকল আলেম একমত যে,জাহরি নামাজে ইমামের কেরাত শুনা অবস্হায় মুক্তাদির সুরা ফাতিহা পাঠ করা লাগবে না।দলিল পবিত্র কোরআনের সুরা আনকাবুতের 204 নং আয়াত- আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন
 " ﻭﺇﺫﺍ ﻗﺮﺉ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﻓﺎﺳﺘﻤﻌﻮﺍ ﻟﻪ ﻭﺃﻧﺼﺘﻮﺍ ﻟﻌﻠﻜﻢ ﺗﺮﺣﻤﻮﻥ "
অর্থ: আর যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর এবং চুপ থাক। যাতে তোমাদের প্রতি করুণা করা হয়।
এ আয়াত সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর বক্তব্য তাফসীরে তাবারী (৯খ. ১০৩পৃ.) ও তাফসীরে ইবনে কাসীরে (২খ. ২৮পৃ.) এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে-
 ﻭﺇﺫﺍ ﻗﺮﺉ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﻓﺎﺳﺘﻤﻌﻮﺍ ﻟﻪ ﻭﺃﻧﺼﺘﻮﺍ ﻟﻌﻠﻜﻢ ﺗﺮﺣﻤﻮﻥ " ﻳﻌﻨﻲ ﻓﻲ
 ﺍﻟﺼﻼﺓ ﺍﻟﻤﻔﺮﻭﺿﺔ
অর্থ : যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমাদের প্রতি করুণা করা হয় অর্থাৎ ফরজ নামাযে। হযরত ইবনে মাসঊদ রা. এর মতও তাই।
তাফসীরে তাবারীতে বলা হয়েছে
: ﺻﻠﻰ ﺍﺑﻦ ﻣﺴﻌﻮﺩ، ﻓﺴﻤﻊ ﺃﻧﺎﺳﺎ ﻳﻘﺮﺀﻭﻥ ﻣﻊ ﺍﻻﻣﺎﻡ، ﻓﻠﻤﺎ ﺍﻧﺼﺮﻑ، ﻗﺎﻝ : ﺃﻣﺎ ﺁﻥ ﻟﻜﻢ ﺃﻥ
 ﺗﻔﻘﻬﻮﺍ ؟ ﺃﻣﺎ ﺁﻥ ﻟﻜﻢ ﺃﻥ ﺗﻌﻘﻠﻮﺍ ؟ ﻭﺇﺫﺍ ﻗﺮﺉ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﻓﺎﺳﺘﻤﻌﻮﺍ ﻟﻪ ﻭﺃﻧﺼﺘﻮﺍ ﻛﻤﺎ ﺃﻣﺮﻛﻢ ﺍﻟﻠﻪ
অর্থাৎ হযরত ইবনে মাসঊদ রা. নামায পড়ছিলেন, তখন কতিপয় লোককে ইমামের সঙ্গে কেরাত পড়তে শুনলেন। নামায শেষে তিনি বললেন : তোমাদের কি অনুধাবন করার সময় আসেনি, তোমাদের কি বোঝার সময় হয় নি? যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং নীরব থাকবে, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করেছেন। (৯ খ. ১০৩ পৃ.)

★ 3নং মাসআলার খ অর্থাৎ (যে নামাজে ইমাম কেরাত আস্তে পড়ে যেমন জোহর ও আসরের নামাজ)এ মাসআলায় আলিমগন দুভাবে বিভক্ত হয়ে গেছেন।যথা-
(ক)ইমাম শাফেয়ি ( রঃ)সহ একদল আলিমের মতে এ সমস্ত নামাজে মুক্তাদির সুরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব।এ দলের প্রবক্তাদের নিকট এমন কোন স্পষ্ট মারফু সহীহ হাদিস নেই, যে হাদিসে রাসুলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে,ইমামের পিছনে মুক্তাদির সুরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব।তারা সহীহ মুসলিমের যে হাদিসখানা পেশ করে এ হাদিসখানা হচ্ছে মাউকুফ হাদিস।
(খ)ইমাম আবু হানিফা (র:)সহ একদল আলিমের মতে,এ সমস্ত নামাজে (যে নামাজে ইমাম কেরাত আস্তে পড়ে)মুক্তাদির সুরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব নয়।তারা তাদের মতের সমর্থনে নিন্মোক্ত দলিলগুলি পেশ করেন-
*হযরত আবূ মূসা আশআরী রা. বলেছেন
, ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ : ﺇﺫﺍ ﻗﺮﺃ ﺍﻹﻣﺎﻡ ﻓﺄﻧﺼﺘﻮﺍ، ﻓﺈﺫﺍ ﻛﺎﻥ ﻋﻨﺪ ﺍﻟﻘﻌﺪﺓ ﻓﻠﻴﻜﻦ ﺃﻭّﻝ ﺫﻛﺮ ﺃﺣﺪﻛﻢ ﺍﻟﺘﺸﻬﺪ . ﺃﺧﺮﺟﻪ ﻣﺴﻠﻢ (৪০৪)
অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন ইমাম কুরআন পড়বে, তোমরা তখন চুপ করে থাকবে। আর বৈঠকের সময় তাশাহহুদ-ই প্রথম পড়তে হবে। মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ৪০৪
*হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেছেন,
 ﻗَﺎﻝَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ - ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ - ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﺟُﻌِﻞَ ﺍﻹِﻣَﺎﻡُ ﻟِﻴُﺆْﺗَﻢَّ ﺑِﻪِ ﻓَﺈِﺫَﺍ ﻛَﺒَّﺮَ ﻓَﻜَﺒِّﺮُﻭﺍ ﻭَﺇِﺫَﺍ ﻗَﺮَﺃَ ﻓَﺄَﻧْﺼِﺘُﻮﺍ ﻭَﺇِﺫَﺍ ﻗَﺎﻝَ ﺳَﻤِﻊَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻟِﻤَﻦْ ﺣَﻤِﺪَﻩُ ﻓَﻘُﻮﻟُﻮﺍ ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﻟَﻚَ ﺍﻟْﺤَﻤْﺪ
অর্থ রাসুলু্ল্লাহ (সাঃ) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইমাম নিয়োগ করার উদ্দেশ্য তাকে অনুসরণ করা । সুতরাং সে যখন তাকবীর বলবে, তোমরাও তখন তাকবীর বলবে। আর যখন কুরআন পড়বে, তখন তোমরা নীরব থাকবে। যখন সে ﺳَﻤِﻊَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻟِﻤَﻦْ ﺣَﻤِﺪَﻩُ বলবে, তখন তোমরা রাব্বানা লাকাল হামদ বলবে। আবূ দাউদ, হাদীস নং ৬০৪; নাসাঈ, হাদীস নং ৯২২-৯২৩
*হযরত জাবির( রাঃ)থেকে বর্নিত,
ﻋﻦ ﺟﺎﺑﺮ ﻗﺎﻝ ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ‏ ﻣﻦ ﻛﺎﻥ ﻟﻪ ﺇﻣﺎﻡ ﻓﻘﺮﺍﺀﺓ ﺍﻹﻣﺎﻡ
 ﻟﻪ ﻗﺮﺍﺀﺓ
অর্থাৎ হযরত যাবের (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা:) বলেন, “যে ব্যক্তির ইমাম রয়েছে(অর্থাৎ যে ইমামের পিছনে নামায পড়বে) তার ইমামের কিরাতই তার কিরাতের জন্য যথেষ্ট হবে(রুহুল মাআনি9/151সুরা আল আরাপ আয়াত নং204 এর তাফসীর)
 এ হাদীসটি সম্পূর্ণ সহীহ এবং অত্র মাসআলায় সর্বাধিক সুস্পষ্ট।
হাদীসটির মাঝে একটি মূলনীতি বলে দেয়া হয়েছে যে, নামায (জিহরী) বা সরব হোক অথবা (সীররী) নীরব হোক সর্বাবস্থায় ইমামের কিরাতই মুক্তাদীর কিরাতের জন্য যথেষ্ট। সুতরাং মুক্তাদীর কিরাত পড়ার কোন প্রয়োজন নেই। উপরোক্ত দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে ,ইমামের কেরাত পড়ার সময় মুক্তাদি চুপ থাকবে । উল্লেখ্য কেরাত বলতে বুঝায় কোরআনের যেকোন আয়াতের তেলাওয়াতকে। চাই তা সুরা ফাতিহা হোক অথবা অন্য কোন আয়াত হোক।
* অপর হাদিসে বর্নিত আছে:-
 ﻋﻦ ﺟﺎﺑﺮ ‏(ﺭﺽ ‏) ﻋﻦ ﺍﻟﻨﺒﯽ ﺳﻠﯽ ﺍﻟﻠﮧ ﻋﻠﯿﮧ ﻭ ﺳﻠﻢ ﻗﺎﻝ ﻣﻦ صلي ﺭﮐﻌۃ ﻟﻢ ﯾﻘﺮﺍ ﻓﯿﮭﺎ ﺑﺎﻡ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﻓﻠﻢ ﯾصل ﺍﻻ ﺍﻥ ﯾﮑﻮﻥ ﻭﺭﺍﺀ ﺍﻻﻣﺎم
অর্থাৎ হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত যে, নবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এক রাকাত নামাজ আদায় করল অথচ সূরা ফাতিহা পড়ল না সে যেন নামাযই পড়ল না। তবে ইমামের পিছনে থাকলে ভিন্নকথা তখন ফাতিহা পড়া লাগবে না।(তিরমিজি হাদিস নং 310)ইমাম তিরমিজি( রঃ)হাদিসখানা উল্লেখ করার পর বলেছেন হাদিসখানা হাসান, সহীহ। 
 এরকম আরও আরও অসংখ্য দলিল রয়েছে যেগুলো দ্বারা বুঝা যায় যে মুক্তাদি ইমামের পিছনে কোন ধরনের কিরাত পড়া লাগবেনা ।আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি অনেক দলিল উল্লেখ করিনি।আল্লাহ তায়ালা এ ফেতনার জামানায় সমস্ত প্রকার বিভাজন দুর করে আমাদের সকলকে হেদায়েতের পথে চলার তাওফিক দান করুক!আমিন!

1 comment:

  1. আলহামদুলিল্লাহ্‌
    জনাব, আরো সহীহ দলিল দিলে লাভবান হতাম

    ReplyDelete